
বিশ্ববিদ্যালয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা চর্চা
শাসনব্যবস্থা, সমাজ ও রাজনীতিকে সহযোগী ও ব্যক্তির জন্য ইতিবাচক হতে গেলে সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে ব্যক্তির নিয়মিত উভয়মুখী সংযোগ থাকতে হবে। এর জন্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সাংস্কৃতিক বাধার বিষয়টি শিক্ষক ও অভিভাবকদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। বাসায় যে ছাত্রকে তার স্বাধীন মতামত প্রদানের জন্য হেনস্তা বা অপমানিত করা হয়, শ্রেণিকক্ষে সে নিজের মত প্রকাশে দ্বিধা বোধ করতেই পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শুধুই জ্ঞাত জ্ঞান অর্জন নয়, এটি বিতর্কের মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির স্থান। শিক্ষকদের দেহের ভাষা, প্রতিষ্ঠানের পদ ও আচরণ ছাত্র-ছাত্রীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংস্কৃতিকে বাধার মুখে ফেলতে পারে। _______________________________________________________________________________
বর্তমান সময়ে অনেক সমাজে মানুষ ক্রমেই মানসিক চাপের মুখে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। মানসিক চাপের মধ্যে বাস করলে মানুষের সহ্যসীমা কমতে থাকে। সহ্যসীমা কমলে মানুষ ভিন্নমত সহ্য করতে চায় না। সেই কারণে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রে বিরোধ ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে। ফলে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সারা দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার একটি আমলাতান্ত্রিক প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। কিন্তু এটা একাডেমিক লক্ষ্য এবং শিক্ষার উদ্দেশ্যের বিপরীত। সে কারণে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করা নয়, ভিন্নমত সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বেশি প্রয়োজনীয়। সেই জন্য উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যাম্পাসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং সেটির মান বাড়ানোর জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো এই উন্নয়নে সচেষ্ট। ক্যাম্পাসে বাকস্বাধীনতা রক্ষার লক্ষ্যে ইংল্যান্ডে একটি নতুন আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই নতুন আইনে জরিমানার সম্মুখীন হতে পারে, যদি তারা ক্যাম্পাসে বাকস্বাধীনতা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়।
ক্যাম্পাসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চায় করণীয়:
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা একটি চলমান সংস্কৃতি। বর্তমানে নানা কারণে সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তরুণসমাজ সেল্ফ-সেন্সরশিপে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় কুফল পড়বে শিক্ষায়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চার বিকাশে বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছে। এগুলো হলো:
১. শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের নিজেকে প্রকাশ করার বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া;
২. বিতর্ক ও সমালোচনার সুযোগ তৈরি করে শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশে অভ্যস্ত করা;
৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তে যতটুকু সম্ভব গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সংস্কৃতির চর্চা করা;
৪. মত প্রকাশ, বিতর্ক ও সমালোচনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেন নেতৃত্বের সূচনা হয় সে প্রচেষ্টা করা;
৫. শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তারা মিলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার একটি ক্যাম্পাস নীতিমালা তৈরি করা;
৬. নতুন শিক্ষার্থীদের নীতিমালা অনুযায়ী মত প্রকাশের স্বাধীনতার গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতার প্রাথমিক ধারণা দেওয়া;
৭. নতুন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রথম দিন থেকেই যেন মত প্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা করতে পারে, তা নিশ্চিত করা;
৮. মতপ্রকাশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে তাদের আচরণে কী আশা করা হচ্ছে আর কী আকাক্সিক্ষত নয়, তা স্পষ্টভাবে নির্ণয় করে সবার দৃষ্টিগোচরে রাখা;
৯. সর্বদা নিয়ম মেনে চলা, বক্তাকে সহায়তা করা;
১০. বিরোধ বাধলে কিভাবে নিষ্পত্তি হবে সেটা আগেই নির্ধারিত থাকা;
১১. শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের একটি স্থান নির্ধারণ করা;
১২. বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের সব সময় নিরপেক্ষ থাকা;
১৩. মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক:
উত্তর আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চায় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিমাপেও তারা সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত। উত্তর আমেরিকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মত প্রকাশের স্বাধীনতার চর্চার জন্য যে পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করছে তার সংক্ষিপ্ত বিষয়বস্তু এমন:
১. মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সংজ্ঞাগুলো তৈরি করা;
২. মত প্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক নীতিগুলো ঠিক করা;
৩. বিশ্ববিদ্যালয় ও তার বিভাগগুলোর জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতাসংক্রান্ত ঘটনাগুলোর তথ্য রাখা, নিয়মিত তদন্ত ও পরিমাপের পদ্ধতিগুলো ঠিক করা;
৪. বিশ্ববিদ্যালয় ও তার বিভাগগুলোর জন্য স্বাধীন মত প্রকাশ ও প্রতিবাদের স্থান নির্ধারণ করা;
৫. বিশ্ববিদ্যালয়, তার বিভাগগুলো যেন নিজেদের মতের বিরুদ্ধে গেলেও ছাত্র-ছাত্রীদের মুক্ত মতের বাধা না হয় তা নিশ্চিত করার নীতি তৈরি করা;
৬. যেসব মত নির্যাতনমূলক, হয়রানি, হুমকি বা আইনবিরুদ্ধ, সেগুলো নিষিদ্ধ করার জন্য নীতি তৈরি করা;
৭. বিশ্ববিদ্যালয় ও তার বিভাগগুলো স্বাধীন মত প্রকাশের চর্চা করলেও তারা যেন অন্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা না হয়, সেটা নিশ্চিত করার নীতি তৈরি করা;
৮. ছাত্র সংগঠনগুলোকে এই নীতিমালায় যুক্ত করা;
৯. বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বিভাগগুলোকে অভিযোগগুলোর তথ্য রক্ষা ও সমাধানের প্রক্রিয়া তৈরি করা;
১০. বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বিভাগগুলোর স্বাধীন মত প্রকাশের চর্চার লক্ষ্যে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের প্রক্রিয়া তৈরি করা।